বর্তমান সময়ে নারীর প্রতি সহিংসতা অন্য যেকোন সময়ের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। রাস্তাঘাটে স্কুল-কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীকে হয়রানির ঘটনা পত্রিকায় অহরহ পাওয়া যায়। দেশে অন্য যেকোন সময়ের চেয়ে নারীর নিরাপত্তার বিষয়টা অনেক জটিল আকারে দেখা দিয়েছে। ঢাকার কুর্মিটোলার মত একটি নিরাপত্তাবেষ্টিত জায়গায় ধর্ষনের শিকার হলো আমাদেরই এক বোন । তাহলে ঢাকার বাইরে অন্যান্য জায়গায় নারীর নিরাপত্তা কতটুকু, প্রশ্ন থেকে যায় ? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাসে বান্ধবির বাসায় যাওয়ার সময় ভুলে কুর্মিটোলা স্টপেজে নেমে যায় । নামার আগ পর্যন্ত নিরাপদে থাকলেও নামার পরে তাকে সম্মুখীন হতে হয় এক বীভৎস অভিজ্ঞতার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী বলে আজ এই দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে আন্দোলন হচ্ছে। এরকম হাজারো নৃশ্ংস ধর্ষনের ঘটনা পত্রিকার পাতা খুললে পাওয়া যায়।কিন্তু এদের পক্ষে আন্দোলন করার কেউ নাই! বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যমতে ২০১৪ সালে ধর্ষনের শিকার হয় ৬৬৬ জন, গণধর্ষনের শিকার হয় ১৭৪ জন এবং ধর্ষনের শেষে হত্যা করে ৯৯ জনকে । ধর্ষনের ধারা ২০১৪ সাল থেকে শুধু বৃদ্ধিই পাচ্ছে । ২০১৫ সালে ধর্ষনের শিকার ৮০৮ জন, ২০১৬ সালে ৮৪০ জন ,২০১৭ সালে ৯৬৯ জন ।বৃদ্ধির ধারা ২০১৮ সালে একটু কমে ৬৯৭ তে আসলেও ২০১৯ সালে এই সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পায়। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালে ধর্ষনের শিকার হয় ১৪১৩ জন । অন্যান্য বছরের তুলনায় ২০১৯ সালে ধর্ষনের শিকার নরীর সংখ্যা প্রায় দ্বিগুন। ধর্ষন ছাড়াও বিভিন্ন সহিংস কর্মকান্ড নারীর সাথে ঘটে । পারিবারিক ভাবে যৌতুকের জন্য নির্যাতন , মারধর এবং আত্মহত্যার বিষয়টি ২০১৯ সাল জুড়ে আলোচিত ছিল। নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় সাংবিধানিক ভাবে নারী এবং পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে । নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন থাকলেও সেগুলো কোন কাজে আসছে বলে প্রতিয়মান হচ্ছে না। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশকে শত্র মুক্ত করতে নারীরা বিভিন্ন ভাবে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছে। পাক হানাদার বাহীনি নারীদের উপর নৃশংস অত্যাচার চালিয়েছে।তাদের উপুর্যুপরি ধর্ষন , ধর্ষনের পর ঠান্ডা মাথায় তাদের বেয়নেটের মাথা দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে হত্যা করে । আজকে দেশে নারীদের সাথে যা হচ্ছে তাতে ১৯৭১ সালের পাক হানাদার বাহীনির বর্বরতার সাথে তুলনা করলে খুব একটা বেশি বলা হবেনা।বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে শাসনকার্য পরিচালনা হচ্ছে নারীদের মাধ্যমে সেই দেশেই দিনের পর দিন নারীর প্রতি সহিংসতা কেন বৃদ্ধি পাচ্ছে বিষয়টা বোধগম্য নয়।আমাদের দেশে নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে অনেকের অনেক বেশি মাথা ব্যাথা থাকলেও নারীর নিরাপত্তার বিষয়টা শুধু মুখে বলেই দায়িত্ব সম্পন্ন করে ফেলে। সমাজে নারীর প্রতি এরকম সহিংস কর্মকান্ডের পিছনে কারন অনুসন্ধান করলে প্রথমেই আমরা দৃষ্টিভংগি নিয়ে আলোচোনা করতে পারি। সমাজে নারীর সঠিক অবস্থান নির্নয়ে ব্যার্থতা এবং নারীকে ভোগ্যপণ্য হিসেবে রুপান্তরিত করা হয়েছে। মূল্যবোধ এবং নৈতিকতার চরম অবক্ষয় নারীজাতির সম্মান বিনষ্ঠ করেছে।পর্নোগ্রাফির সহজল্ভ্যতার কারনে যুবসমাজ তাদের কুবাসনা অনৈতিক উপায়ে চরিতার্থ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। আর সাংবিধানিক ভাবে যে নীতিমালা আছে সেটার সুষ্ঠ ব্যাবহার হচ্ছে না। অপরাধী শনাক্ত হলেও সেটার বিচার প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হচ্ছে না। নারীদের সম্মান নিশ্চিত করতে সাংবিধানিক আইনের সুষ্ঠ ব্যাবহার নিশ্চিত করতে হবে। ধর্মীয় মুল্যবোধ পরিবার থেকে শিক্ষা দিতে হবে। ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে । অশ্লীল পত্র-পত্রিকা ও বইয়ের ব্যবসা বন্ধ করে দিতে হবে। পর্ন সাইট গুলো বোন্ধ করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও নারীদের বিভিন্ন ভাবে হয়রানি করা হয় । সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সুষ্ঠ ব্যাবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সভা সেমিনারের আয়োজন করে তরুণদের উদ্দ্বদ্ধ করতে হবে।রাষ্ট্র আইন প্রণয়ন করেছে ঠিকই কিন্তু সেই আইনের প্রয়োগ ঠিক মতো হচ্ছে কিনা তা পর্যবেক্ষন করা। এমনকি কঠোর আইন করেও কোন লাভ হবেনা যদি সেটা ক্ষমতাশালীদের প্রয়োজনে বা কোন রাজনৈতিক দলের প্রয়োজনে ব্যবহার করা হয়।এজন্য নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে আইন প্রয়োগে কোন প্রতিবন্ধকতা রাখা যাবেনা । কোন প্রতিবন্ধকতা থাকলে স্বাভাকিভাবেই সহিংসতা রোধ করা সম্ভব হবেনা সর্বোপরি নারীর সহিংসতার বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে ।
লেখকঃ মোঃ শফিকুল ইসলাম নিয়ামত
শিক্ষার্থী রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ , রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
No comments:
Post a Comment