চারতলা থেকে তিন তালা নামছি। দুই তালার দুইটা সিঁড়ি নামার পর আর নামতে পারতাছে না। শরীর একেবারে দুর্বল হয়ে গেছে। আমি বললাম যে বসবা? উনি বলল বসবে। বসায়া দিছি আর হেইলা পড়ছে। তখন আমি কান্নাকাটি করতাছি আর জল ছিটা দিতেছি। তিন তালার এক ভাড়াটিয়ার কাছে আমার মেয়ে গিয়ে বলল, আন্টি আমারে একটু জল দেন। মেয়েরে ধমক দিয়ে দরজা আটকায়া দিছে ভাড়াটিয়া। একটু জল দেয় নাই।
রোববার দুপুরে করোনা উপসর্গ নিয়ে নিজ বাসার সিঁড়িতেই মারা যান খোকন সাহা। মৃত্যুর আগ মুহূর্তে তার পরিবারের সাথে ঘটে যাওয়া করুণ ঘটনা এভাবেই বলছিলেন খোকন সাহার স্ত্রী তৃষা সাহা।
খোকন সাহা নারায়ণগঞ্জ শহরের গলাচিপা এলাকায় নিজ বাড়ির চতুর্থ তালায় বৃদ্ধা মা, স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে থাকতেন। বেশ কয়েকদিন যাবত অসুস্থ। এর মধ্যেই অবস্থা গুরুতর হয়। হাসপাতালে নেওয়ার জন্য ফোন করে আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীদের ডাকতে থাকেন স্ত্রী তৃষা সাহা। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি। বাধ্য হয়ে শাশুড়ির সহযোগিতা নিয়ে নিজেই হাসপাতালে নেওয়ার জন্য সিঁড়িতে নামতে থাকেন। কিন্তু অসুস্থ শরীর নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামার ধকল নিতে পারেননি। তিন তলাতে নামার পরেই শরীর ছেড়ে দেয়।
স্ত্রী তৃষা সাহা জানান, অ্যাম্বুলেন্স রাস্তায় আছিল। আমরা নিচে নামানোর চেষ্টা করতেছিলাম। অ্যাম্বুলেন্স দিয়া আমরা ঢাকা নিয়া যাইতাম। সবাইরে ডাকছি একটা লোকও আসে নাই। কেউ নাকি ধরবে না। আমি শাশুড়ি আর আমার মেয়ে ধইরা নামানোর চেষ্টা করি। তিন তালার ভাড়াটিয়ার কাছে আমার মেয়ে পানি চাইছিল। ধমক দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিছে।
সিঁড়িতে যখন খোকন সাহা ছটফট করছিলেন তখন সন্তানের এমন অবস্থা দেখে বৃদ্ধা মা দৌঁড়ে চারতালায় গিয়ে পানি নিয়ে আসেন ছেলেকে খাওয়ানোর জন্য। মুখে সামান্য পানি দেওয়া মাত্র সেখানেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন খোকন সাহার। এরপর প্রায় তিন ঘণ্টা সিঁড়িতেই তার লাশ পড়ে ছিল। আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশী কেউ এগিয়ে আসেনি।
মৃত্যুর খবর পেয়ে আত্মীয়রা করোনার ভয়ে কেউ আসেনি। তারা সিটি কর্পোরেশনের ১৩ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাকসুদুল আলম খন্দকার খোরশেদকে ফোন করে খবর দেন। কাউন্সিলর খোরশেদকে যখন ফোন করা হয় তখন তিনি মাসদাইর কবরস্থানে করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত এক ব্যক্তির লাশ দাফনে ব্যস্ত ছিলেন। সেই আত্মীয়কে খোরশেদ অনুরোধ করে বলেছিলেন যাতে তারা সৎকারের ব্যবস্থা করে। কিন্তু তার অনুরোধেও কেউ এগিয়ে আসেনি। কয়েক ঘণ্টা পর আবারো ফোন করা হলে কাউন্সিলর খোরশেদ স্বেচ্ছাসেবী টিম নিয়ে ছুটে যান মৃতের সৎকারে। স্বেচ্ছাসেবী দলের সাহায্যে সিঁড়িতে পড়ে থাকা লাশ নামিয়ে নিজেদের গাড়ি দিয়ে শ্মশান পর্যন্ত নিয়ে আসেন লাশ। আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে কেউ শ্মশানে যায়নি। যে কারণে মুখে আগুন (মুখাগ্নি) দেওয়ার দায়িত্বও পড়ে কাউন্সিলর খোরশেদের। কাউন্সিলর খোরশেদও সেই দায়িত্ব সাদরে গ্রহণ করেন। লাশ নিয়ে চলে আসার সময় নিহতের স্ত্রীকে কথা দিয়ে আসেন যে যথাযথ সম্মানের সাথেই লাশের সৎকার করবেন।
কাউন্সিলর খোরশেদ বলেন, এই মহা দুর্যোগের সময়ে আপনারা প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজনরা সারা দিচ্ছেন না। এতে মানবিক সংকটের সৃষ্টি হচ্ছে। আমরাও মানুষ আপনারাও মানুষ। সেই মেয়ে দুইটির কথা চিন্তা করে দেখেন তাদের মনের কি অবস্থা। তারা বাবাকে দীর্ঘক্ষণ সিঁড়িতে পড়ে থাকা অবস্থায় দেখেছে। দয়া করে আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশীর মৃত্যুর পর তাদের সম্মান রক্ষা করেন। খোকন সাহা এক শ্যালক, এক ভাই ফোন করে আমাকে জানায়, তাদের এক আত্মীয় মারা গেছে। আমি তাদের অনুরোধ করি যাতে তারা যেন নিজেরা কোনো ব্যবস্থা করেন। কিন্তু তারা কেউ এগিয়ে আসেননি। আমরা গিয়ে দেখি তিন তালার সিঁড়িতে মৃতদেহ পড়ে আছে। আমার বিশেষ বার্তা হচ্ছে, হিন্দু মুসলিম কোনো ধর্ম নিয়ে নয়। মানুষের প্রতি মানবতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। খোকন সাহা একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। বন্ধুদের নিয়ে তিনি ৭তালা বাড়ি করেছেন। সেই বন্ধুরা পর্যন্ত খোকন সাহার দুই কন্যার ডাকে সাড়া দেয়নি।
সুত্র মানবকণ্ঠ
No comments:
Post a Comment